বিশেষ প্রতিনিধি: বিশ্বজুড়ে করোনার হানা। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। এ প্রাণঘাতির সংক্রমণ এড়াতে দেশজুড়ে সাধারন ছুটি ঘোষনা করে সরকার। ঘরমুখো হয় কর্মব্যস্ত মানুষ।
আক্রান্তের খবরে, শুরু হয় বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন। বন্ধ হয়ে যায়, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান অফিস-আদালত। কমে যায় ঢাকা শহরের রাস্তায় নাগরিক কোলাহল।
রাজধানীর বুকজুড়ে থেকে যায় ঘরহীন, ছিন্নমূল মানুষগুলো। করোনা মহামারীর এ দূর্যোগে, কেমন করে আহার মিলবে এসব অসহায় মানুষের। এ চিন্তা থেকে, এদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদে এক শিক্ষার্থী নেমে পড়েন করোনা ‘যুদ্ধে’।
পকেটে জমানো তার ১৩ হাজার টাকা। প্রথম দিকে কিছু ছিন্নমূল মানুষের হাতে তুলে দেন চাল ডাল খাদ্য সামগ্রী। পরে, তারা রান্না করবেন কোথায়? এই ভেবে, বিতরণ শুরু করেন রান্না করা খাবার।
এ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে, ২৪ মার্চ সহযোগিতা চেয়ে পোষ্ট দেন ফেসবুকে। এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিত দু’ বেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন হাজারো অসহায় মানুষের হাতে।
বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। সংসারে আছে আদরের ছোট দু’ বোন। করোনার ভয়ে, রোজ-রোজ মুঠোফোনে বাড়ি ফেরার আকুতি মায়ের। সন্তানের বাড়ি ফেরার প্রতিক্ষায় জলেভরা চোখ মোচেন মা। আর ছেলের অপেক্ষা অসহায় মানুষের খাদ্য সঙ্কট মেটানোর, করোনা ‘যুদ্ধ’ জয়ের।
বলছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’র (ডাকসু) সদস্য তানভীর হাসান সৈকতের কথা।
২৩ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অসহায় মানুষের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ এ খাবার পাচ্ছেন। রমজানে বিকেল ৫টায় ইফতার ও রাতে আড়াইটা থেকে ৩ টায় সেহরী বিতরণ করেন সৈকত এবং তার টিম।
দুপুরে ভিন্ন ধর্মের অসহায় মানুষের জন্যও রয়েছে খাবার ব্যবস্থা। প্রতিদিন মানুষ খাবার নিচ্ছে সুশৃঙ্খল পরিবেশে সামাজিক সুরক্ষা নিয়ম মেনে।
খাবার নিতে আসা মানুষগুলোও জেনে গেছেন এখানকার নিয়ম। সৈকতদের এঁকে দেয়া সামাজিক সুরক্ষা চিহ্ন, বৃত্তে কিংবা লাইন করে দাঁড়াতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা।
যদিও প্রথম দিকে, এ সামাজিক সুরক্ষা দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড় করাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে সৈকত ও তার টিমকে। আর এখন লাইন অমান্য করলে খাবার নিতে আসা মানুষরাই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৩ মার্চ থেকে এ কার্যক্রম শুরু করেন সৈকত। ২৪ মার্চ নিজের কাজ নিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দেন ‘শোঅফ’ উল্লেখ করে।
লিখেন, “শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি। মানুষ হিসেবে নৈতিকতাবোধ থেকে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। প্রতিদিন ৫০ জন মানুষের পাশে খাবার নিয়ে আমি সৈকত শো-অফ করবো।
আপনি চাইলে শো-অফ করতে পারেন। আমাদের শো-অফের কারনে যদি কিছু মানুষ খাবার পায় মন্দ কিসে।…কেউ যদি সহযোগিতা করতে চান যোগাযোগ (০১৬৮৪০২৩৪১১) করতে পারেন। যে যার অবস্থান থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ান আর নিরাপদে থাকুন।”
এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশের কর্মকর্তা, সহপাঠী-বন্ধুসহ বিভিন্নজন অর্থ সহায়তা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
স্বেচ্ছায় শ্রমও দিচ্ছেন অনেকেই। টিএসসি এলাকায় নিজেরাই রান্না করছেন প্রতিদিন। বাড়ি না গিয়ে টিএসসির অতিথি কক্ষ ও নিজেদের প্রয়োজনে বানিয়ে নেয়া স্টোর রুমের ফ্লোরে ঘুমান সৈকত ও তার টিমের জাহিদুল ইসলাম, মাহিদুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, ইসরাফিল পাবেল, মানিক হোসেনসহ কয়েকজন।
স্বল্প পারিশ্রমে রান্না করে দিচ্ছেন টিএসসি এলাকার এক চটপটি বিক্রেতা।
এ খাবার নিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, হাইকোর্ট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, গুলিস্তাসহ শহরের দূর-দূরান্তের খাদ্য সঙ্কটে থাকা অসহায় ছিন্নমূল মানুষেরা। ২৩ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ৫২ দিন ধরে চলছে এ পথচলা।
সবাই পাশে থাকলে, করোনা সঙ্কট যতদিন থাকবে,ততদিন এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ইচ্ছে সৈকতের।
লক্ষ্মীপুরের ‘লক্ষ্মী’ সন্তান তানভীর হাসান সৈকত। স্কুল জীবন থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। পড়ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে।
ডাকসু সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গণরুম প্রথা উচ্ছেদ, হল ক্যান্টিনের খাবারের মান বাড়ানো নিয়ে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক সদস্য।
খাবার নিতে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলো এখন সৈকতের পরিবারের মতো। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও প্রতিদিন ওইসব মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে ছুটছেন সৈকত ও তার টিম।
এ করোনা ‘যুদ্ধের’ শেষ হবে কবে? কখন ফিরবেন বাড়ি, জানা নেই তাদের। তবুও অসহায় মানুষের হাতে খাবার তুলে দিতে সৈকতদের ক্লান্তিহীন পথচলা।
প্রতিবেদক/ প্রবাস সময়/এমআর ” ”> ” ”>