বউ-জামাই এমপি, যাদের ‘ম্যানেজ’ করেছিলেন পাপুল!

প্রকাশঃ

শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হবার পর তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ‘ঝড়’ বইছে।

দেশের রাজনৈতিক মাঠে তাকে কখনো দেখা যায়নি।

তবুও উড়ে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য হলেন। তার স্ত্রীকেও সংসদ সদস্য বানালেন।

একবাক্যে সমালোচকরা বলছেন, ‘টাকার বিনিময়ে পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সংসদ সদস্য হয়েছেন।’
এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কে বা কোন নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে তিনি এমপি হলেন, স্ত্রীকে এমপি বানালেন। তার টাকা কার পকেটে গেল?

এ নিয়ে বিস্তারিত আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদকের প্রতিবেদনে

মেঘনার উপকূলের জেলা লক্ষ্মীপুর। আর এ জেলার পান সুপারীর জন্য সুখ্যাতি রায়পুর উপজেলার।
রায়পুর উপজেলা ও সদরের একটি অংশ নিয়ে লক্ষ্মীপুর-২ সংসদীয় আসন।

তথ্য অনুসন্ধানে জানাগেছে, এ আসন থেকে দু’বার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া।
রাজনৈতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ এলাকায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বাড়ি। যারা দীর্ঘসময় ধরে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

এমন নির্বাচনী আসনে উড়ে এসে জুড়ে বসেন কুয়েত প্রবাসী ব্যবসায়ী পাপুল।

তার পৈত্রিক বাড়ি রায়পুর উপজেলা কেরোয়া ইউনিয়নে হলেও সেখানে তার যাতায়াত ছিল না। ছোটবেলা থেকে চট্রগ্রাম ও ঢাকায় তার বেড়ে উঠা।

২০১৬ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে লক্ষ্মীপুরে পা রাখেন কাজী পাপুল। ওইদিন সন্ধ্যায় রায়পুরের একটি চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে মতবিনিময় করেন। ‘মিট দ্যা প্রেস’ নামের ওই মতবনিমিয়ের পরিচালনা করেন পাপুলের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত জিল্লুর রহমান।

মতবিনিময়ে এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্মীপুরে উপকূল রেডিও স্থাপন,সয়াবিন ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার আশ্বাস দেন। এবং রায়পুরকে জেলা করার ঘোষণা দিয়ে ‘হাস্যরসের’ জন্ম দিয়ে আলোচনায় আসেন।

নিজেকে কুয়েতের ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কুয়েত শাখার সভাপতি পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘জন্মের পর রায়পুরে এবারই প্রথম এসেছি। আমার অর্থ-বিত্তের অভাব নেই। রাজনৈতিক উচ্চাবিলাস নেই। রায়পুরের মানুষের সেবা করতে চাই।’

ওইদিন তাকে স্বাগত জানিয়ে উপজেলার বিভিন্নস্থানে অর্ধ শতাধিক তোরণ নির্মাণ করেন রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগ আহবায়ক কাজী বাক্কি বিল্লাহ।
পরে জেলা ও রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে ম্যানেজ করে নেন। আর এই ‘ম্যানেজ’ নেতৃত্ব দেন কাজী বাক্কি বিল্লাহ।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্মীপুর সফরে গেলে ওইদিন জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে পাপুলকে মঞ্চে অতিথির আসনে দেখা যায়। সেদিন জেলার অনেক প্রবীণ নেতা মঞ্চে উঠার সুযোগ পাননি।

এনিয়ে ওই সময়ে ক্ষিপ্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিলো, কোটি টাকার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করেই পাপুল মঞ্চে অতিথি হন।

ঘনিয়ে আসে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পাপুল রায়পুর আসনে প্রার্থী হতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার দরবারে শুরু করেন জোর লবিং। একপর্যায়ে জেলা উপজেলা ছাড়াও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে ম্যানেজ করে নেন।

বিশেষ করে চট্রগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। গুঞ্জন রয়েছে, চট্রগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতাকে কোটি টাকায় গাড়িও কিনে দিয়েছিলেন পাপুল।

জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ ছাড়াও, তার অনুসারী কর্মীদের কিনে দিয়েছিলেন অর্ধ শতাধিক মটরবাইক।

যদিও শুরু থেকেই রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একটি অংশ পাপুলের বিরোধীতা করেন। তবে পাপুলের টাকার তোপে টেকেনি সে বিরোধীতা।

একাদশ নির্বাচনের আগে পাপুলের ‘গেমে’ বাদ সাজে মহাজোট। লক্ষ্মীপুর-২ রায়পুর আসন ভাগে পায় আওয়ামী লীগের মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টি। মনোয়ন পান কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির নেতা মোহাম্মদ নোমান। দশম সংসদ নির্বাচনেও ওই আসনটি জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়।

ফলে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এতে তার পক্ষে অবস্থান নেয় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বড় একটা অংশ।

নিবাচনের দুইদিন আগে রহস্যজনকভাবে নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে গা-ঢাকা দেন মহাজোট প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান।

ওই সময় অভিযোগ উঠে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মহাজোট প্রার্থী নোমানকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেন কাজী পাপুল।

বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল খায়ের ভূঁইয়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সেটা ছিল নামেমাত্র।
কারন বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনের কোথাও নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়নি। ভোটের দিন কেন্দ্রে দেখা মেলেনি এজেন্টদের।

ফলে তার পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবস্থানে খালি মাঠেই আপেল প্রতিক নিয়ে জয়ী হন পাপুল। নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কয়েক নেতাকে ম্যানেজ করে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে কুমিল্লার একটিপ আসন থেকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করেন।

নামে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই তার নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকটি দলীয় সভা সমাবেশে তাকে দেখা যায়। তাকেই ঘিরেই চলছিল ওই উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড।

নির্বাচনের আগে জনগণকে দেয়া অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি তিনি।

উপজেলাতে তাঁর উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করেন তাঁর ঘনিষ্ট সহোচর হিসেবে পরিচিত রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কাজী জমশেদ কবির বাকী বিল্লাহ।

আর জেলার সদর উপজেলার আংশিক এলাকার দায়িত্বে রয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের ভাই আদনান চৌধুরী।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, ১৯৯২ সালে তাঁর ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরেই কুয়েতে পাড়ি জমান কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।

দেশে-বিদেশে রয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যবসা অর্থের উৎস্য নিয়ে এখন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কুয়েতে থাকা তাঁর প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার কর্মী কাজ করছেন।

পাপুলের কুয়েতে গ্রেফতার নিয়ে রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক জমশেদ কবীর বাকি বিল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এমপি পাপুল দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার। তাকে ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে তার কোম্পানীর শ্রমিক দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা, মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগ সত্য নয়।

অন্যদিকে রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ইসমাইল খোকনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ বলছেন, পাপুলের কারনে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে।

পাপুল আওয়াামী লীগের কেউ নয়। টাকার বিনিমিয়ে তাকে এবং তার স্ত্রীকে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা এমপি বানিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হোক।

উল্লেখ্য, সংসদ সদস্য পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতে মানব ও মুদ্রা পাচারে অভিযোগ এনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। গত শনিবার কুয়েতের মুশরিক এলাকার বাসা থেকে পাপুলকে আটক করে সিআইডি।

পরে তার কোম্পানীতে কর্মরত পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় এবং রিমান্ডের আবেদন করলে তা মঞ্জুর করে আদালত।

ওই পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগ, কুয়েতে যেতে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে শহিদ ইসলাম পাপুল ৩ হাজার দিনার ও প্রতিবছর ভিসা নবায়ন করতে বাড়তি টাকা নিয়েছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক/ঢাকা/এমআর

সর্বশেষ খবর

সৌদিতে ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু

0
  সৌদি আরবে কাজ করার সময় ভবনের ৩য় তলার ছাদ থেকে পড়ে মো. ইউছুপ (২৬) নামে এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বৃহম্পতিবার (৫ অক্টোবর) এ...

জনপ্রিয় খবর