লক্ষ্মীপুর: জেলার রায়পুরে পরিবহন খাতে প্রতি মাসে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা (জিপি) আদায় করা হচ্ছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েক নেতা এ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
এতে করে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পরিবহন মালিক শ্রমিক ও যাত্রীরা ভয়ে প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছেন না।
স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে জিপির নামে প্রকাশ্যে আদায় করা হচ্ছে এ চাঁদা।
পরিবহন মালিক ও চালকদের অভিযোগ, প্রতিটি বাস ও সিএনজি স্ট্যান্ড এবং এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মালিক সমিতি ও শ্রমিক সমিতির নামে বিভিন্ন সংগঠন। যার নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতারা।
বাস, ট্রাক, টেম্পো, মাইক্রো বাস, সিএনজি ও অটোরিকশা ও ট্রলির ৫টি স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন এ চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
আদায়কৃত চাঁদার যাভাগ যায় বড় নেতা, পাতিনেতা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। মাঝে মাঝে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হঠাৎ ধরপাকর হলেও আবারও শুরু হয় জিপির নামে চাঁদা উত্তোলন।
কয়েকজন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ও বাস মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিটি স্ট্যান্ডকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ নামধারীরা স্বঘোষিত মালিক ও শ্রমিক নেতা সেজে কমিটি গঠন করে রেখেছেন।
প্রতিটি স্ট্যান্ডে রয়েছে তাদের লাইনম্যান। এরা নির্ধারিত হারে বাস, ট্রাক, মাইক্রো, ট্রলি, সিএনজি ও অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায় করে থাকেন। চাঁদা পরিশোধ না করে কারও পক্ষে স্ট্যান্ড ব্যবহার অসম্ভব। চাঁদা পরিশোধ করা না হলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত ঈদেও দু’দিন পর মজুচৌধুরী ঘাট এলাকায় ৪টি মাইক্রো গাড়ি আটক করে মালিকের কাছ থেকে পুলিশের নামে ২০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে।
চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে রায়পুর পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হাজী ইসমাইল খোকনের বলেন, “বৈধ ইজারার মাধ্যমে তিন স্ট্যান্ড থেকে টাকা তোলা হচ্ছে। এ টাকা পৌরসভার উন্নয়নে খরচ করা হয়। চলতি মাসে নতুন করে ইজারার আহ্বানের কথা ছিলো। কিন্তু করোনার কারনে বন্ধ রয়েছে।”
রায়পুর পরিবহন সেক্টরের খোঁজ-খবর রাখেন এমন লোকজন জানান, বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। পরিবহন চাঁদাবাজির সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে দেখা দিয়েছে সিএনজি চালিত এ অটোরিকশা।
রায়পুর-চাঁদপুর, রায়পুর-চৌমুহনী রুটে আনন্দ পরিবহন নামে ৮২টি বাস প্রতিদিন চলাচল করছে। প্রতিদিন প্রতিটি বাস রায়পুরে ১১৫ টাকাসহ ৬৩৫ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
রায়পুর-চট্রগ্রাম রুটে ৪৭টি ও রায়পুর-ঢাকা রুটে ৪০টি জোনাকি পরিবহন নামের বাস এবং ৫০টি শাহী পরিবহন বাস রয়েছে।প্রতিটি বাস প্রতিদিন ২০ টাকা ও ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
রায়পুর-ঢাকা সড়কে ৩০টি ঢাকা এক্সপ্রেস নামে বাস চলাচল করছে। এদেও প্রত্যেকটি বাস থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
রায়পুর থেকে কুমিল্লা সড়কে ১০টি বোগদাদ নামের বাস চলাচল করছে। প্রত্যেকটি বাস প্রতিদিন ৯০ টাকা করে দিতে হয়।
১২০টি মাইক্রোবাসের প্রত্যেকটিকে চাঁদপুরে ৮০০ ও লক্ষ্মীপুরে ট্রাফিক বিভাগকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
রায়পুর ট্রাক ষ্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারি প্রায় ২ শতাধিক পন্যবাহী ট্রাককে জনপ্রতি ৭০-১২০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। ছোট-বড় পণ্যবাহী থেকে পৌরসভা কর্তৃক নির্ধারিত ১০-১৫ টাকা হারে নেয়ার নির্দেশনা থাকলেও ইজারাদার ওহীদ উল্লাহ তার ৬ জন লাইনম্যানের মাধ্যমে ৪০,৭০ ও ১২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছেন।
লক্ষ্মীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইন্জিন) অনুজ চন্দ্র বলেন, “জেলায় সিএনজি আটোরিকশার লাইসেন্স আছে ৭ হাজার ২০০টি। হাজার-হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করে থাকে স্ট্যান্ড কমিটিকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে।
মে মাসে অভিযান হয়নি। তাছাড়া প্রতি মাসেই নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে আদালত পরিচালনা হয়ে থাকে। কোন চালক বা লোককে লাইসেন্স পেতে হয়রানি করা হয় না বলে দাবি ।
রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সড়কের সিএনজি স্ট্যান্ডে কথা হয় সিএনজি চালক রহমত ও নূর ইসলামের সঙ্গে। তারা দুঃখের সঙ্গে বলেন, “রুটে চলাচল করতে তাদের ভর্তি হিসেবে তিন-চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। গাড়ি চালাতে দিতে হয় প্রতিদিন ৩০ টাকা।”
চাঁদপুর রুটের তারেক হোসেন ও মনোয়ার জানান, “তারা লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করে রেখেছেন। কিন্তু বিআরটিএ লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে রেখেছে। এখন প্রতি মাসে ৩০০ টাকা পরিশোধ করে স্ট্যান্ড থেকে টোকেন নিতে হয়। রাস্তায় পুলিশকে স্ট্যান্ডের টোকেন দেখিয়ে চলাচল করতে হয়। টোকেন দেখাতে না পারলে গাড়ি আটক হয়ে যায়। মামলা করা হয়।”
রায়পুর সংশ্লি¬ষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে, প্রতিদিন শহরের থানার কর্নারে, বাসটার্মিনাল, সাবেক শহীদ মিনারের সামনে,মধ্যবাজারের মোড়ে এসব বাস, সিএনজি,অটো, ট্রাক ও মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। তবে করোনায় কয়েকটি স্পটে ১০, ৭০, ১২০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়াও ১০টি ইউনিয়নের গুরুত্বপুর্ণ স্থানে এসব ষ্টান্ড রয়েছে।
পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জেলার অন্যতম ব্যাস্ত রায়পুর-চাঁদপুর-কুমিল্লা, নোয়াখালি, রামগন্জ সড়কের রায়পুর বাসস্ট্যান্ড।
রায়পুরের এসব স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ, রায়পুর পৌরসভার মেয়র ইসমাইল খোকন, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ আহব্বায়ক তানভির হায়দার চৌধুরী রিংকু, সাবেক যুবলীগ সম্পাদক শফিক খান, আওমায়ামী লীগ কর্মী মো. ডালিম, বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম লিটন, আবুল কাশেম দেওয়ান, মো. বাবুল প্রমুখ।
এরআগে কয়েকটি ষ্ট্যান্ড রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগ আহবায়ক কাজী জামশেদ বাক্কি বিল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করলেও, গত বছর তাকে দলীয় কোন্দলে সরে যেতে হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ দেশে করোনার আগে বিভিন্ন স্ট্যান্ডে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তবে করোনায় সময়ে তা বন্ধ রয়েছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা না হলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে না। বরং পরবর্তী সরকারের আমলে আরও বৃদ্ধি পাবে।
সহকারি পুলিশ সুপার (রায়পুর ও রামগন্জ সার্কেল) স্পীনা রানী প্রামানিক জানান, গত ৮দিন আগে সড়কে পরিবহন থেকে চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে পুলিশ সুপার স্যার সংশ্লিষ্ট সবাইকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। পরিবহন মালিকরা অভিযোগ করলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের আহ্বায়ক তানভীর হায়দার চৌধুরী বলেন, “স্ট্যান্ডে কোন চাঁদাবাজি হয় না। রায়পুর পৌরসভা থেকে গত জুন মাসে ২২ লাখ টাকায় ইজারা নিয়ে ১০ ও ২০ টাকা করে জিপি উত্তোলন করছি।”
রায়পুর-হায়দরগন্জ ও আলোনিয়া সড়ক নিয়ন্ত্রনকারি সাবেক যুবলীগ নেতা শফিক খান বলেন, “৩ লাখ টাকায় ইজারা নিয়ে ১০ টাকা করে উত্তোলন করছি। রায়পুর-চাঁদপুর- রামগন্জ-মীরগন্জ ও গাজিনগর সড়ক নিয়ন্ত্রকারি মোঃ ডালিম একই বক্তব্য দিয়েছেন।”
রায়পুর আনন্দ পরিবহনের মালিকদের সমন্বয়কারী শিপন ভুঁইয়া মোবাইলে বলেন, “৮২টির মধ্যে ৭০টি বাস চাঁদপুর-রায়পুর-লক্ষ্মীপুর ও চৌমহনী সড়কে চলাচল করছে। প্রায় ৮ মাস আগে পুলিশ সুপারের নির্দেশে ডিবি পুলিশ অভিযানে কয়েকজন লাইনম্যানকে আটক করে জেলে পাঠিয়েছিলেন। অনিয়মের মাধ্যমে দায়িত্ব নেয়া শ্রমিকলীগ নেতা ভুট্রু ও খোকন তাদেরকে ছাড়িয়ে এনেছেন।”
নিজস্ব প্রতিনিধি/লক্ষ্মীপুর/এমআর ” ”> ” ”>