বয়স ৬৮ বছর। এ বয়সেও তিনি ছুটে চলেন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে, মানুষের দ্বারে দ্বারে।
করোনার প্রাদুর্ভাবে সারাদেশে যখন লকডাউন পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তখন তিনি ‘ঘরবন্দী’ কর্মহীন গরিব-অসহায় মানুষের বাড়িতে হাজির হচ্ছেন। পায়ে হেঁটে অথবা বাই সাইকেলে। নিজেই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন খাদ্য সামগ্রী।
ঘটনাটি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের। তিনি চরকিাদিরা ইউনয়েন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কেন আমি আরও আগে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাইনি। আরও ২০-৩০ বছর আগে এই দায়িত্ব মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা যেতো।
আমি এখন প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওলামায়েকেরামদের উৎসাহিত করছি। আর সবাইকে বলছি, তোমরা আল্লাহপাকের কাছে কি জবাব দেবে? শুধুই কি রশিদ দিয়ে টাকা কালেকশন করে মাদরাসা করবা? আর সরকারি অর্থ সবাই লুটপাট করে খাবা।
আল্লাহপাকের কাছে কি জবাবদিহি করা লাগবে না? মানুষের সেবা করাও একটা ইবাদত। জনসেবা ও জনগণের খেদমত করাটা অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে উত্তম ইবাদত। মানুষ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায়। আর আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হল জনসেবা করা’।
মাওলানা সাইফুল্লাহ আল্লাহ প্রেমী, সৎ ও জনদরদী একজন চেয়াম্যান। চাল-চলন, পোশাক-আশাকে তিনি একজন সাদামাটা মানুষ হলেও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে খুবই সচেতন। প্রবীণ এ আলেম মানুষের কাছে ‘মিরপুরী হুজুর’ হিসেবেই পরিচিত।
দেশব্যাপী লকডাউন পরিস্থিতি চলাকালীন এ সময়ে তিনি এলাকার জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন- ‘অভাবের কারণে ইউনিয়নে যদি কাউকে না খেয়ে থাকতে হয়, তবে আমি সাইফুল্লাহ সর্ব প্রথম না খেয়ে থাকব। কারো ঘরে ভাতের চাল না থাকলে, কারো পকেটে সদাই করার টাকা না থাকলে, সরাসরি আমার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। আমার পকেটে টাকা থাকতে, আমার ঘরে একমুঠো চাল থাকতে, চরকাদিরায় কেউ না খেয়ে থাকবে না। ইনশাআল্লাহ।’
এ ব্যাপারে তিনি জানান, সরকার থেকে যখন ঘোষণা এসেছে করোনায় সঙ্গরোধে রাখতে জনগণের জন্য ১ টন চাল ও ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। তখনই তার কার্যালয়ে বিতরণের জন্য রাখা ভিজিডির চাল ও নিজের ১০ হাজার টাকা ১ হাজার মানুষের মাঝে বিতরণ করেন।
তবে কাউকে পাঠিয়ে নয়, নিজ হাতে প্রকৃত হতদরিদ্র মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দিয়ে এসেছেন। পরে বরাদ্দ আসলো, বরাদ্দের সেই চাল ভিজিডি তহবিলে রাখা হয়েছে। আবারো ঘোষণা এসেছে আরও একটন করোনায় সঙ্গরোধে মানুষের জন্য দেওয়া হবে। আবারও তিনি ওই চাল বিতরণ করেন। যা এখনো অব্যাহত আছে।
কিন্তু এখনো বরাদ্দের বাকি ১ টন চাল তিনি বুঝে পাননি। এছাড়া চালের সঙ্গে নিজের পকেট থেকে, ২০ থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত সবাইকে দিয়ে আসছেন।
ঘুষ-দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাইফুল্লাহ হুজুর জানান, আল্লাহ ঘুষ-দুর্নীতিকে হারাম করেছেন। কিন্তু এটা অহরহ চলছে। দেশের সরকারি বিভিন্ন দফতরে অঘোষিত একটা আইন রয়েছে। যেকোন কাজকর্মেই অফিসে পার্সেন্টিস দিতে হয়। তাঁর দায়িত্বের তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে।
অফিসকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কাউকে অগ্রিম ঘুষ দিয়ে কোন কাজ করাতে পারবেন না। ফাইলে স্বাক্ষর হোক বা না হোক, কাউকেই ঘুষ দেবেন না তিনি।
কারণ পরকালে নিজেকে তিনি দায়ী করতে পারবেন না। তবে কাজ করার পরে যদি কোন টাকা উদ্বৃত্ত থাকে সেটি এলাকার দরিদ্র তহবিলে জমা দেওয়া হবে। তখন সেখান থেকে কিছু টাকা অফিসের ঘুষ চাওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া যেতে পারে। তবে তাদের চাহিদা অনুযায়ী নয়। দরিদ্রদের যেভাবে দেওয়া হবে, তাদেরকেও ঠিক সেভাবে দেওয়া হবে। এটি ঘুষ বা দুর্নীতি হবে না।
রাজনীতি সম্পর্কে তিনি জানান, রাজনীতির সঙ্গে তিনি ছাত্র জীবন থেকেই জড়িত। ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুর বটগাছ মার্কায় নির্বাচন করেছিলেন।
ওই নির্বাচন কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন। মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজনৈতিক সাপোর্ট কাজে দেয়। সরকারি অর্থ যেভাবে লুটপাট হচ্ছে, করুন নির্যাতন চলতেছে। এগুলো ওয়াজ-মাহফিলে বলতে গেলে মানুষ বলে রাজনীতি শুরু করে দিয়েছি।
ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওয়াজ করবো এটা শুনতে সবার ভালো লাগবে। কিন্তু মাঠে নেমে কেউ কাজ করে না। ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার মনোভাবে তিনি নির্বাচন করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে তিনি ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কাজ করছেন। আলেম চেয়ারম্যান হিসেবে বড় বড় অফিসাররাও তাকে সম্মান করেন বলে জানান তিনি।
চেয়ারম্যান-মেম্বারদের লুটপাট নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারি ভিজিডি কার্ড তার ইউনিয়নে ২৫৫ টি রয়েছে। এরমধ্যে ৭৯টি তিনি নিজে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খুঁজে খুঁজে যোগ্যদের দিয়েছেন। চালও নিজেই বিতরণ করেন। যাদেরকে কার্ড দিয়েছেন তারা বিনা খরচেই ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছে দুই বছর ধরে। মেম্বাররা কি করেছেন সে বিষয়ে তিনি জানেন না। কেউ কোন অভিযোগও করেননি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়েই তিনি সকল ধরণের উন্নয়নমূলক কাজ তদারকি করেন।
নির্বাচনের ব্যয় সম্পর্কে প্রবীণ এই জনপ্রতিনিধি বলেন, আমার নির্বাচনে ব্যায় হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পাওয়া সহযোগীতা তার চেয়েও ২৫ হাজার টাকা বেশি পেয়েছি। তবে একটাকাও কাউকে দিতে বলিনি। সবাই নিজের ইচ্ছেতেই দিয়েছেন। আর অনেকেই নিজ উদ্যোগেই ব্যক্তিগতভাবে আমার নির্বাচনের সময় খরচ করেছেন।
আমার মেম্বাররা মাঝে মাঝে বলেন, হুজুর আপনিতো বিনা পয়সায় চেয়ারম্যান হয়েছেন। আর অন্য ইউপি চেয়ারম্যানরা কোটি টাকা খরচ করেছেন। ২০১৬ সালে ৪ জুন নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিজয়ী হন। একই বছর নভেম্বরে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এরআগে তিনি ২০০৮ সালে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) সংসদীয় আসনে হাতপাখা মার্কায় প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা।
সাইকেল চালানো ও স্যান্ডেল পায়ে দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জানান, তিনি ঢাকা থেকে একেবারে চলে আসার পর একটা পনেক্স সাইকেলে কেনেন। তখন এলাকায় এতো পাকা রাস্তা ছিল না। কাদা ভরপুর থাকতো রাস্তা। এজন্য সাইকেলেই বেশি চলাচল করতেন।
এখন রাস্তায় অনেক গাড়ি পাওয়া যায়, এজন্য তিনি সাইকেল কম ব্যবহার করেন। তবে ইউনিয়নে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলো তদারকি করতে তিনি গাড়িতে না গিয়ে সাইকেলে যান। তিনি নিজেও চামড়া জুতা পড়েন। তবে স্যান্ডেল পড়তে তাঁর আরামদায়ক মনে হয়। এ কারণে এলাকায় তিনি বেশিরভাগই স্যান্ডেল পায়ে দেন। মূলত সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে তিনি পছন্দ করেন।
গ্রামে এসে বসবাসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে যায়। ৭৩ সনে তিনি ঢাকাতে গিয়ে লেখাপড়া আরম্ভ করেন। এরআগে লক্ষ্মীপুরে লেখাপড়া করেছেন। পরে ঢাকাতেই কর্মজীবন ও সেখানে বিয়ে করেন। গ্রামে আসার তাঁর কোন মানসিকতা ছিল না।
হঠাৎ তাঁর মনে জাগলো শহরেতো মসজিদ মাদ্রাসায় কর্ম করার মত দ্বীনি লাইনের ব্যক্তির অভাব নেই। কিন্তু পরকালে এলাকার লোকজন যদি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, উনি দ্বীনের জন্য অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু আমাদের জন্যতো কিছু করেননি। তো তিনি এটার জবাব কি করে দেবেন।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহপাক বলেছেন, আপনার প্রতিবেশি আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে দ্বীনের কাজটি শুরু করুন। কোরআন শরীফের একটি আয়াতে আছে, এলেম শিক্ষার জন্য বাইরে যাবেন, কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের এলাকার জনগণের খেদমত করুন। তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করুন। তিনি এই উদ্যেশ্যেই ঢাকা ছেড়ে এলাকাতে চলে আসেন। নতুবা আজ ঢাকা শহরে অন্যান্য বড় বড় ওলামায়েকেরামদের মত পজিশনে তিনিও থাকতেন।
সাইফুল্লাহ হুজুর আরও জানান, তাঁর ৬ একর জমি রয়েছে। সেখানে তাঁর বাসা ও নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা রয়েছে। জমিগুলো তিনি ২০০০ হাজার সালে ক্রয় করেন। গত তিন বছরে তিনি কোন জমি কেনেননি। তিনি একটা ভাঙ্গা টিনের ঘরে থাকতেন। এরআগে তার ঘরটি ছিল ছনের (নলখাগড়া)।
চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তিনি আত্মীয়-স্বজনদের থেকে কর্জে হাসানা (ধার) নিয়ে ৫ কক্ষ বিশিষ্ট একতলা একটা বাসা নির্মাণ করেন। সেখানেই তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। এছাড়া নির্বাচনের জন্য ২০০৬ সালে তিনি ব্যাংক হিসেব খুলেছেন। এরআগে কখনো তিনি ব্যাংক হিসেব খুলেননি।
চেয়ারম্যান হওয়ার পরে করলে লোকে নানা ধরণের সমালোচনা করতেন। একারণে আগেই ধার নিয়ে বাসাটি নির্মাণ করলাম। কিন্তু এখনো টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। তাঁর ৫ ছেলে ও ৬ মেয়ে। ছেলে চার জনই চরকাদিরায় তার প্রতিষ্ঠিত আতহারুল মোহাম্মাদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকতা করেন। এরমধ্যে কোরআনে হাফেজ, মুফতি ও আলেম রয়েছেন। তিনি দুই বিয়ে করেছেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। সন্তানদের মধ্যে দুইজন প্রথম সংসারের।
জানা গেছে, ১৯৫২ সালে সাইফুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৃত মো. ওজি উল্যাহ। সাইফুল্লাহ ঢাকাস্থ মাদানীনগর মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস। মিরপুরের মুসলিম বাজার মাদরাসার মুহতামিমও ছিলেন তিনি। চরকাদিরা ইউনিয়নের মানুষের কাছে শুধু চেয়ারম্যান হিসেবেই নয়, প্রবীণ আলেম হিসেবেও তার অনেক খ্যাতি রয়েছে। তবে তার সম্পর্কে এলাকার মানুষের একটা বাড়তি বিশেষণ রয়েছে, যেটি মানুষের কাছে বড় সমস্যাও মনে হয়। তার ইউনিয়নের মানুষের ভাষায়- হুজুরের একটাই সমস্যা, তিনি মিথ্যা বলেন না। তাদের কথা হলো, ‘এ যুগে কি (দু-একটা) মিথ্যা না বললে হয়!’
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সাদামাটা পোশাক ও স্যান্ডেল পরে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। ঘরে ঘরে অসহায়দের খাদ্য-সামগ্রী পৌঁছে দেয়াকে তিনি এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মনে করছেন। তার পুরো মনোযোগ করোনায় ঘরে আটকে পড়া গরিব অসহায় মানুষের ওপর।
প্রবীণ এ আলেম চেয়ারম্যান বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় অন্যান্য চেয়ারম্যানসহ সমাজের সব বিত্তবানদের জন্য হতে পারেন সুযোগ্য আইডল। সমাজসেবায় তিনি সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি, আলেম-ওলামা ও জনসাধারণের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি পুরো সমাজে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ‘চেয়ারম্যান হলেই আমল-ইবাদত ও সত্যবাদিতা থেকে দূরে সরে যেতে হয় না। সত্যবাদিতার সঙ্গেই সমাজের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সমাজের উন্নয়নে সত্যবাদী ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া উচিত। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সাদামাটা আলেম মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ।
জানতে চাইলে চরকাদিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম সাগর বলেন, সাইফুল্লাহ হুজুর খুব ভালো মানুষ। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি জনগণের জন্য কাজ করছেন। এলাকায় কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে তিনি ছুটে যান। সকল কাজে আমদেরকেও সঙ্গে রাখেন। ইউনিয়নের সবাই তাকে ভালো জানেন।
কাজল কায়েস/ বিশেষ প্রতিনিধি