মো. নিজাম উদ্দিন: দীর্ঘ দেড় বছর থেকে লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির কমিটি নেই। পূর্বের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার দেড় মাসের মধ্যে নতুন কমিটি দেওয়ার কথা ছিল।
দেড় বছর পার হলেও নতুন কমিটি দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় কমিটি। অভিবাবকহীন থাকার কারণে লক্ষ্মীপুরে সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় রয়েছে দলটি।
অপরদিকে চরম অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত জেলা বিএনপি। জেলার শীর্ষ তিন নেতার কর্মী সমর্থককরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে বিএনপি অধ্যুষিত এলাকাটি দিন দিন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কর্মী হারাচ্ছে দলটি। আর অঙ্গ সংগঠনগুলোও নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
তবে জেলার নেতৃবৃন্দ আশা করছেন, করোনা মহামারির সঙ্কট কেটে গেলে জেলা কমিটি গঠন করা হবে। আর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে চাঙ্গা হবে সংগঠনটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারিতেও স্থানীয় নেতারা তৃণমূলের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। শুধুমাত্র নিজেদের সমর্থিত গুঁটি কয়েক কর্মীদেরকে নামমাত্র সহযোগীতা করেছেন জেলার কয়েকজন শীর্ষ নেতা।
সাধারণ কর্মীরা মনে করছেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নতুন কমিটি দেওয়ার পাশাপাশি কোন্দল নিরসনে কার্যকর প্রদক্ষেপ নিতে হবে কেন্দ্রকে। তা না হলে বিএনপি এ জেলাতে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ৯ মার্চ কেন্দ্রীয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে বলা হয়। বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর-সদর আংশিক) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাহাবুদ্দিন সাবু।
এরপর থেকে জেলাতে এ দুই নেতার দুই গ্রুপ তৈরী হয়। বিশেষ করে সদর উপজেলাতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। এ পক্ষের নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার বিষয়ক সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী এবং আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দেন জেলা বিএনপি সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু।
আবার আবুল খায়েরের পক্ষের লোক ছিলেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী। সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে সাবু-এ্যানীতে পৃথক হয়ে যায় এ আসনের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
তৃণমূল পর্যায়ে সাবেক সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া এবং কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী অনুপস্থিত থাকলেও মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছিলেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে তৃণমূলকে নেতৃত্ব দিতেন সাবু। তবে তৃণমূলে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও এ্যানী এবং সাবুর মধ্যে দ্বন্ধ বাঁধে। এক পক্ষ একটি কমিটির অনুমোদন দিলে অন্য পক্ষ পাল্টা আরেকটি কমিটির অনুমোদন দেওয়ার নজির রয়েছে এখানে। এছাড়া বিভিন্ন দিবসসহ সাংগঠনিক কর্মকান্ডও আলাদাভাবে পালন করতে দেখা গেছে।
সাধারণ কর্মীরা জানান, বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ে যখন সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হতো তখন সাবু তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের খোঁজ নিতেন, আর এ্যানী চৌধুরী খোঁজ নিতেন তাঁর সমর্থিতদের।
অন্যদিকে সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়েরকৃত মামলার বিষয়টি দেখতেন এড. হাসিবুর রহমান। তবে নিজ নির্বাচনী এলাকা না হওয়ায় সদর আসনের আওতাধীন নেতাকর্মীদের খোঁজ রাখতেন না সাবেক সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া।
অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন নিজের পছন্দমত কমিটি দিতেন সাবু। নিজের দল ভারী করতে মূল সংগঠন ছাড়াও অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতো নিকটাত্মীয়-স্বজনরা। এ নিয়ে চরম বিতর্ক দেখা দেয় দলের মধ্যে।
আর সাবেক সভাপতি আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, দলের দুর্দিনে নেতাকর্মীদের খোঁজ না রাখা। এছাড়া আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়া। সংঘর্ষে জড়ান বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা সমন্বয়ক কর্নেল (অবঃ) আবদুল মজিদের সাথে।
২০১২ সালের ৩১ আগষ্ট আবদুল মজিদ লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়নে গণসংযোগ চলানোর সময় আবুল খায়ের ভূঁইয়ার কর্মীদের মধ্য সংঘর্ষ বাঁধে। এতে গোলাগুলিতে নিহত হয় ওই ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা দিদার হোসেন। তিনি আবুল খায়ের ভূঁইয়া সমর্থিত কর্মী ছিলেন। এ ঘটনায় তখন লক্ষ্মীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
জেলার শীর্ষ পদ প্রত্যাশী যারা :
পূর্বের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে জেলার নতুন কমিটির জন্য সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন সাবেক সভাপতি ও সাংসদ আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু। সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন দুই জন। তাঁরা হলেন, জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এড. হাছিবুর রহমান, যিনি দলের দুর্দিনে সাধারণ নেতাকর্মীদের আইনী সহায়তা দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। অন্যজন হলেন সদর থানা বিএনপির সভাপতি মাঈন উদ্দিন চৌধুরী রিয়াজ।
জানা গেছে, এড. হাসিব সভাপতি প্রার্থী সাহাবুদ্দিন সাবুর সমর্থিত এবং রিয়াজ সাবেক সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীর সমর্থিত। নতুন কমিটির জন্য প্যানেল গড়তে পারেন আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও মাইন উদ্দিন চৌধুরী রিয়াজ এবং সাহাবুদ্দিন সাবু ও এড. হাসিব। তবে কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় সাধারণ নেতাকর্মীদের মতো তাঁদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে।
জেলা কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এড. হাসিবুর রহমান বলেন, করোনাকালীন সঙ্কটের কারণে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দলীয় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আশা করছি, এ সঙ্কট কেটে গেলে কেন্দ্র থেকে জেলা কমিটি ঘোষণা করা হবে।
আভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়ে তিনি বলেন, দলের নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং এবং কোন্দল রয়েছে। তবে জেলা কমিটি গঠন হলে কোন্দল আর থাকবে না বলে আশাবাদি তিনি।
নিজস্ব প্রতিবেদক/লক্ষ্মীপুর/এনইউ