স্কুল জীবনে সম্পৃক্ত হন ছাত্র রাজনীতিতে। ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগ। রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন ৩৮ বছর। মৃত্যুকালে ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তবুও তার সম্বল বা সম্পদ বলতে ৫০ বছরের পুরনো একটি জরাজীর্ণ টিনের ঘর।
করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পর ওই আওয়ামী লীগ নেতার ঘরের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের অসংখ্য মানুষওই ছবি পোষ্ট করে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানান।
নুরুল ইসলাম বাবুল (৫৫) নামের এ আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের রাম কৃষ্ণপুর গ্রামে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এদিকে, জনপ্রিয় এ চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পরদিন (সোমবার) সকাল সাড়ে ১০টায় স্থানীয় কলেজ মাঠে পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে জানাজার সময় ঘোষণা দেয়া হলেও, হঠাৎ করে সবার অগোচরে নিদ্দিষ্ট সময়ের আড়াইঘন্টা আগে (সকাল সাড়ে ৭টায়) দাফন সম্পন্ন করা হয়।
এতে করে জানাজায় অংশ নিতে না পেরে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও সাধারন মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দলীয় সূত্র ও স্থানীয়রা জানায়, নুরুল ইসলাম বাবুল স্কুল জীবনে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ গ্রহনের মধ্যে দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। স্থানীয় স্কুল, কফিল উদ্দিন কলেজ, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বে ছিলেন। সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ ও আশপাশ এলাকায় হাত ধরে ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী সৃষ্টি হয়।
তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক। রাজনীতি করতে গিয়ে অসংখ্যবার হামলা মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তার বাবা অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর রাজনীতি ও পরিবারের কারনে তিনি ওই সম্পদ হারান।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাক থেকে শুরু করে বর্তমান সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে তার রাজনীতির গভীর সখ্য ছিল। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন থেকে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি ইউনিয়নের উন্নয়নে ও মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
তার নিরলস প্রচেষ্টায় ওই ইউনিয়নের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়ন ছিলো জেলার শীর্ষে। করোনা মহামারির শুরু থেকে তিনি একজন ‘করোনাযোদ্ধা’ হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। তার ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে ও প্রবাস ফেরত ব্যাক্তিদের প্রতিটি বাড়িতে তাকে করোনা নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে দেখা গেছে। নিজ হাতে ছিটিয়েছেন জীবানুনাশক ওষুধ।
ইউনিয়নে করোনায় আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের ঘরে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে। গত ১৪ আগষ্ট তিনি করোনায় আক্রান্তের খবর জানান ফেসবুকে। ১৫ আগষ্ট সন্ধ্যায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় কফিল উদ্দীন কলেজ মাঠে সামাজিক সুরক্ষা মেনে তার জায়নামাজের সময় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু হঠাৎ, সবার অগোচরে অনিবার্য কারন দেখিয়ে সকাল সাড়ে ৭টায় কয়েকজন সেচ্ছাসেবীর উপস্থিতিতে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। এতে জায়নামাজে অংশ নিতে না পেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল প্রশাসনকে করোনা সংক্রমনের দোহাই দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জেলার কোথাও সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। তাহলে করোনাযোদ্ধা জনপ্রিয় চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের জানাজা সামাজিক দূরত্ব মেনে সম্পন্ন করতে প্রশাসনের আপত্তি কেন?
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী বাবুল ৩৮ বছর আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও, তার সম্বল বলতে বাবার তৈরী করা ৫০ বছরের বেশী পুরনো একটি টিনের ঘর। আওয়ামী লীগ একটানা ১২বছর ক্ষমতায়, তিনি জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তবুও অর্থের মোহে ছুটেননি।
এলাকাবাসী বলছেন, নুরুল ইসলাম বাবুলের মতো সৎ নেতা বর্তমান সময়ে বিরল। তিনি জীবনে কখনো নীতি ও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। তার ওই টিনের জরাজীর্ণ ঘরে কয়েকজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতার পা পড়লেও তিনি কখনো আর্থিক সুবিধার কথা চিন্তা করেন নি।
বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ বিক্রি করে রাজনীতি করেছেন। সুযোগ থাকলেও কখনো আর্থিক সুবিধা নেননি। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে দুই মেয়ে ও স্ত্রী রেখে গেছেন। তার পরিবারের সম্পদ বলতে এখন একটি জরাজীর্ণ ঘর আর নুরুল ইসলাম বাবুলের সততা নীতি আদর্শ।
নিজস্ব প্রতিনিধি/লক্ষ্মীপুর/এমআর