গেল বছর লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্যখাতে যন্ত্রপাতি ওষুধ ও কেনাকাটায় (এমএসআর) সরকারের বরাদ্দ ছিল ১৮ কোটি টাকা। তবুও উন্নতি হয়নি জেলার স্বাস্থ্যখাতের।
অভিযোগ রয়েছে, বরাদ্দের অধিকাংশ টাকা গেছে স্বাস্থ্যখাতের মিঠু ‘সিন্ডিকেটের’ সদস্য ঠিকাদার হারুনের পকেটে। ঢাকার স্বাস্থ্যখাতের সিন্ডিকেট ও জেলার সিভিল সার্জনসহ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ‘ম্যানেজ’ করে অনিয়মের মাধ্যমে হারুন হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার কাজ।
ফলে ‘সিন্ডিকেট’ ঠিকাদার হারুন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারি অঢেল সম্পদের মালিক হলেও জেলার স্বাস্থ্যখাতের নানা সঙ্কট ও বেহাল অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন জেলার কয়েক লাখ মানুষ।
সরকারি হাসপাতালে ফ্রিতে ওষুধ দেয়ার কথা থাকলেও ৮০ভাগ বাইর থেকে কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ৯০ভাগ স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাইরে করতে হচ্ছে।
হারুনুর রশিদ দেশের স্বাস্থ্যখাতের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মিঠু ‘সিন্ডিকেটের’ অন্যতম সদস্য। তিনি মের্সাস জুয়াইরিয়া ইন্টারন্যাশনাল নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। যার ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা ২৫/২ তোপখানা রোড।
এদিকে, জেলার স্বাস্থ্যখাতের ২০১৯-২০ সালের যন্ত্রপাতি, ওষুধ, কেনাকাটা (এমএসআর) সামগ্রীর দরপত্রের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে গত ৪ অক্টোবর দুদকে লিখিতি আবেদন করেছেন স্থানীয় ঠিকাদার মনিরুজ্জামান পাটোয়ারী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
অভিযোগে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্যখাতে যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কেনাকাটায় (এমএসআর) জন্য প্রায় ১৮ কোটি টাকার দরপত্রের আহবান করা হয়। যার স্মারক নং-উঃস্বাঃকঃ/কমল/২০১৯-২০/৩৭ তারিখঃ ১৩/০১/২০২০ ইং।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা রামগতি, লক্ষ্মীপুর, দরপত্রের স্মারক নং- উঃস্বাঃকমঃ/রামগতি/২০১৯-২০২০/৫২ তারিখঃ ২৩/০১/২০২০ইং, এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, দরপত্রের স্মারক নং-উঃস্বাঃরায়ঃ/লক্ষ্মী/২০১৯-২০২০/২০৫ তারিখঃ ২৯/০১/২০২০ইং।
এ কাজের জন্য ১৬ টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। এতে ৩০-৪০ভাগ কম দরে সর্বনিন্ম দরদাতা ছিল মেসার্স রাজু এন্টার প্রাইজ। এরপরেই ২৫-৩০ ভাগ কমে দ্বিতীয় দরদাতা আলিফ সার্জিক্যাল নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু গত মার্চ মাসে এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে সিভিল সার্জন গোপনে ‘সিন্ডিকেট’ ঠিকাদার হারুনের জুয়াইরিয়া ইন্টারন্যাশনালের নাম প্রস্তাব করে অনুমোদনের জন্য ঢাকায় প্রেরণ করেন। পরে সর্বনিম্ন কয়েকটি দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে হারুনের মেসার্স জুয়াইরিয়া ইন্টারন্যাশনালকে অধিক দরে কার্যাদেশ দেয়া হয়।
এতে করে কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাখিলকৃত দর মোতাবেক বিল পরিশোধ করতে সরকারের অতিরিক্ত প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
২০১৮-২০ অর্থ বছরেও একই ভাবে সিন্ডিকেটের ঠিকাদার হারুনুর রশিদ অনিয়মের মাধ্যমে জেলার স্বাস্থ্যখাতের এমএসআর কাজ নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার জানান, দেশের স্বাস্থ্যখাতে বহুল আলোচিত ‘মিঠু সিন্ডিকেট’। মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু ও তার সহযোগীদের দৌরাত্ম এখনো রয়েছে। এ চক্রের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে ব্যপক অনিয়ম ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার ক্রয়ে কোনরূপ যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে সমস্ত টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
মিঠু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও ভারত এবং বাংলাদেশে তার এজেন্টের মাধ্যমে সকল কলকাঠি নেড়ে থাকেন। নামে বেনামে এ সিন্ডিকেটের রয়েছে বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু উচ্চপদস্তসহ বিভিন্ন স্তরের অসাধু কর্মকর্তা ঠিকাদার মিঠু বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অনিয়মের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্যখাতের কাজ হাতিয়ে নেয়া মো. হারুনুর রশিদ ওই মিঠু সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। হারুন কয়েক মাস আগেও যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে মিঠুর সাথে সাক্ষাত করেন।
২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত হারুনুর রশিদ অনিয়মের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর স্বাস্থ্যখাতের যন্ত্রপাতি, ওষুধসহ সরবরাহের অর্ধশত কোটি টাকার বেশি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন।
ঢাকা থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ হাতিয়ে নিলেও স্থানীয়ভাবে সিভিল সার্জন ও তার কার্যালয়ের কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারিও এ কাজে তাকে সহায়তা করছেন।
মালামাল গ্রহন ও বিল প্রদান কালে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক, মো. দেলোয়ার হোসেন, প্রধান সহকারী মো. জায়দুল হক সিন্ডিকেটের ঠিকাদার হারুনকে সহায়তা করে এখন কোটিপতি। এছাড়াও এই দুই কর্মচারী লক্ষ্মীপুর আধুনিক হাসপাতাল, উপশম হাসপাতালসহ প্যাথলজি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে।
২০১৭-১৮ সালে অতিরিক্ত বরাদ্দ থেকে দেলোয়ার একাই ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনেন।
দেলোয়ার হোসেন ও জায়েদুল হক দীর্ঘ ১৭ বছর এ কার্যালয়ে নানা অনিয়ম করে যাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে গত ০৬/০৮/২০১৮ তারিখে লক্ষ্মীপুর-৩ সদর আসনের সাংসদ সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী কে এম শাহাজাহান কামাল অন্যত্র বদলীর জন্য অনুরোধ করলে মন্ত্রীর উপ সচিব বিভাগের সচিব বদলীর নির্দেশ দেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তদবীর করে তারা এখানেই থেকে যান।
হাসপাতালের অডিট বিভাগও হারুন সিন্ডিকেটে ম্যানেজ থাকায় মিলছে না দরপত্র মতো যন্ত্রপাতি ওষুধ ও মালামাল। এছাড়া হারুনের বিরুদ্ধে দরপত্র দাখিলের সময় মোটা অংকের টাকার বিনিমিয়ে স্থানীয় টেন্ডার সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাধারন ঠিকাদারদের ভয়ভীতি দেখানোরও অভিযোগ রয়েছে।
জেলার সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার বরাদ্দ দিলেও হাসপাতালগুলোতে এখনো নানা সঙ্কট রয়েছে। সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর ল্যাবে নেই অধিকাংশ যন্ত্রপাতি। সদর হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিনসহ অধিকাংশ যন্ত্রপাতি নেই।
হারুন দু’মাস আগে ৩০টি কিট দিয়ে ৩০০টি দিয়েছেন মর্মে সদর উপজেলার এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে স্বাক্ষর করতে বলেন।স্বাক্ষর না করায় তাকে অন্যত্র বদলী করেন সিভিল সার্জন।
রোগীদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নেয়ার পর সংশ্লিষ্ট ফার্মেসীতে বিনামূল্য ওষুধ পাওয়া যায়না। দু’একটি ওষুধ মিললেও অধিকাংশ ওষুধ বাহিরে থেকেই কিনতে হয়।
স্থানীয় ঠিকাদার ও জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য মনিরুজ্জামান পাটোয়ারী বলেন, ‘হারুন সিন্ডিকেট ও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারনে জেলার স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা। কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে দরপত্রে উল্লেখিত অধিকাংশ মালামাল সরবরাহ হচ্ছেনা।
এতে করে জেলার অসহায় মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। লক্ষ্মীপুরের স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে দ্রুত দুদকের হস্তক্ষেপ প্রযোজন।’
এ ব্যপারে জুয়াইরিয়া ইন্টারন্যাশনালের হারুনুর রশিদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা যায়নি।
অপরদিকে লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন আবদুল গফ্ফারের মুঠোফোনে কল করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় জানার পর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।
নিজস্ব প্রতিনিধি/লক্ষ্মীপুর/এমআর