রাস্তায় ছুটছে কয়েক তরুণ। পথচারি ও যানবাহন থামিয়ে চালকদের হাতে তুলে দিচ্ছে জীবানুমুক্তকরণ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাক্স।
ফেসবুকে ভেসে ভেড়ানো এমন চিত্র, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারের। এরা ছাত্রদলের স্থানীয় নেতাকর্মী।
ছাত্র তরুণ যুবারা ছুটছে, অজোপাড়া গাঁয়ে। নিজেদের সামর্থ মতো, ঘরবন্দী কর্মহীন হতদরিদ্র মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে চাল ডালসহ খাদ্য সামগ্রী। মফস্বল শহরের দোকানের সামনে রং হাতে তারা।
এঁকে দিচ্ছে ‘সুরক্ষা রেখা’। ফেসবুক ও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরের তথ্যমতে, এ তরুণরা লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী।
এমন মানিবকতার চিত্র শুধু এ দু’টি জেলাতে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের অধিকাংশ জেলাগুলোতে এ চিত্র দেখা যাচ্ছে ফেসবুকসহ সোশাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমের খবরে।
এমন চিত্র দেখার ‘সৌভাগ্য’ এনে দিয়েছে মারন করোনা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২৯মার্চ রোববার পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৯টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার মানুষ। এর মধ্যে ৩৩ হাজার ২২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন, ১ লাখ ৪৯হাজার ২১৯জন। করোনা ভাইরাসের হানার বাইরে নেই বাংলাদেশও। সরকারি হিসেব মতে, দেশে ৪৮জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৫জনের। যদিও গণমাধ্যমের হিসেব মতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও বেশি।
দেশে জনচলাচলে সরকারি যে নির্দেশনা বা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তা এ রোগের সংক্রামণ থেকে রক্ষা পেতে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী। এ নির্দেশনার শুরুতে, জন সাধারনকে ঘরে ফেরাতে পুলিশের লাঠির্চাজ বা মারধর কিংবা প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা কর্তৃক কান ধরে উঠবস্ করানোর খবর প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
মানুষ ঘরে ফিরে, বিপাকে পড়ে নিন্ম আয়ের মানুষেরা। মানুষদের প্রতি অমানবিক যে পুলিশ, তারাও এখন মানবিক।করোনা আতঙ্কে জনচলচাল সীমিত হওয়ায় জীবিকা ও খাদ্য সঙ্কটে পড়েছিলেন নওগাঁ জেলার পত্নী তলায় এক বৃদ্ধ।
খবর পেয়ে ২৯মার্চ ফুলচান নামের ৮০বছরের ওই বৃদ্ধকে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেন ওখানকার থানা পুলিশ।
২৮ মার্চ বগুড়ার শিবগঞ্জে সর্দি কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মাসুদ রানা নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী মারা যায়। করোনায় মৃত হয়েছে ভেবে, এলাকাবাসী দাফনে বাধা সৃষ্টি করে। খবরপেয়ে শিবগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজেরা জানাযা পড়ে মাসুদের দাফনের করে।
যে পুলিশের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিনিয়ত নেতিবাচক খবর, এখন তাদের মানবিকতার এমন অসংখ্য খবর হচ্ছে গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায়।
প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা অনিয়ম দূর্নীতির খবরও দীর্ঘদিনের। করোনায় ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বর্তমানে প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তারাও একযোগে কাজ করছেন নিরলস।
২৯ মার্চ, বরগুনায় ঘরে খাবার নেই ভ্যান চালক সেলিম মিয়ার। পরিবারের চার সদস্যদের আহার মেটাতে আসেন বরগুনা বাজারে। দোকনপাট বন্ধ থাকায় কাজ নেই তার। এসময় ক্ষুধা আর তপ্ত রোদের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন ভ্যানের ওপর।
এসময় তার ঘুম ভাঙ্গে স্থানীয় ডিসি মোস্তাইন বিল্লাহর ডাকে। অসহায়ত্বের কথা শুনে তুলে দেন চাল ডালসহ খাদ্য সামগ্রী। শুধু সেলিম মিয়া নয়, এভাবে পায়ে হেঁটে কর্মহীন মানুষদের সরকারি সহায়তা তুলে দেন ওই জেলা প্রশাসক। তার মতো এমন অসংখ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার খবর প্রকাশ হচ্ছে।
যে ডাক্তার-নার্সদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার বিস্তর অভিযোগ ছিলো রোগীদের। সেই ডাক্তার-নার্সরা এখন নিজেদের উৎসর্গ করছেন মানব সেবায়। নিজেদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকার পরও রাত-দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে থাকছেন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের পাশে। ইতোমধ্যে চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনায় কয়েকজন ডাক্তারও আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতাকর্মী, সকল বয়সের; শ্রেণী-পেশার মানবিক মানুষের মিছিল মিলেছে এখন একই পথে। সেই পথ মানবিকতার।
অতিতে, রাষ্ট্রের এসব সেক্টরগুলোর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দূর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতার ছিল অভিযোগ। কিন্তু তাদের বর্তমান চিত্র একেবারে ভিন্ন। এ যেন, একাত্তরে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।
মারন ভাইরাসে কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ, কেড়ে নিচ্ছে পরিবারের স্বপ্ন। বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিয়ে হয়ত; আরও প্রাণ ঝরাবে এ নির্দয়া করোনা।
এতো-এত্তোসব বিষাদেও; শুরু হওয়া মানবিকতা অটুট থাকুক। কাঁদে-কাঁদ রেখে অব্যাহত থাকুক সত্য ও সুন্দরের জয়গান । শুধু করোনা ভাইরাস কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগ নয়, জয় হোক সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। জয় হোক এমন মানবিক বাংলাদেশের।
আবুল কালাম আজাদ, সম্পাদক
