পাপুলকে শেল্টারদাতা আওয়ামী লীগ নেতারা ধোয়া তুলসি পাতা?

প্রকাশঃ

বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার। এ খবরে যেন বুকের পাঁজর ভেঙ্গেছে রাজনীতি সচেতন, দেশপ্রেমী মানুষের।

পাপুল ব্যবসায়ী, অঢেল সম্পদের মালিক। তিনি টাকার বিনিময়ে এমপি হয়েছেন। বউকেও এমপি বানিয়েছেন।

‘মানি ইজ দ্য সেকেন্ড গড’ বহুশ্রুত এই কথার বাস্তব প্রয়োগ দেখিয়েছেন তিনি। প্রতিটা মানুষেরই স্বপ্ন থাকে। তিনি টাকা দিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন।

টাকার বিনিময়ে তিনি সংসদ সদস্য হয়ে ‘অপরাধী’ হলে, তাকে আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শেল্টার দিয়েছেন তারা কি দুধের ধোয়া তুলসি পাতা?

শুধু কি পাপুল ও তার স্ত্রী উল্টোপথে সংসদ সদস্য হয়েছেন? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের তালিকায় আর কেউ নেই যারা আওয়ামী লীগ দূরের কথা, জীবনে রাজনীতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন না।

সময় এখন দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির। দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও রাজনীতি সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুর্নীতি নেই কোথায়, আর কারা ‘সুবিধা’ নিয়ে এসব দুর্নীতিবাজদের সুযোগ করে দিচ্ছেন। তারাও কি সমান অপরাধী নয়?

পেশাগত কাজের কারনে পাপুলের সঙ্গে পরিচয় ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যায়। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের একটি চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে, ‘মিট দ্যা প্রেস’ নামের অনুষ্ঠানে। তখন আমি মফস্বলের সংবাদকর্মী।

তার পৈত্রিক বাড়ি রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নে হলেও সেখানে তার যাতায়াত ছিল না। ছোটবেলা থেকে চট্রগ্রাম ও ঢাকায় তার বেড়ে উঠা।জন্মের পর ওইদিনই তিনি লক্ষ্মীপুরে প্রথম আসেন।

‘মিট দ্যা প্রেসে’ তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্মীপুরে উপকূল রেডিও স্থাপন, সয়াবিন ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার আশ্বাস দিলেও সেটা এখনো আলোরমুখ দেখেনি।

২০১৭ সালের ১৪ মার্চ, লক্ষ্মীপুর সফরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগের দিন পাপুল লক্ষ্মীপুর এসে আবারও জেলা শহরের একটি চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

ওইদিন বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের কারনেই বাংলাদেশের দুরবস্থা।’

তখন তাকে বলেছিলাম, ‘দেশের যদি কোন দুরবস্থা থাকে, তার জন্য আপনার মতো ব্যবসায়ীরা দায়ি। কারন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন করছেন আপনার মতো ব্যবসায়ীরা। আর গণমাধ্যমের মালিকানাও চলে যাচ্ছে কালো টাকার মালিক ব্যবসায়ীদের হাতে।’

এতে কোন উত্তর না করে, লজ্জায় মাথা নিচু করে মুখ লুকান তিনি। আর তার পাশের চাটুকার হা করে তাকিয়ে দেখেন।’

প্রথম যেদিন তিনি লক্ষ্মীপুর আসেন, সেদিন নিজ কার্যালয়ে তাকে সংবর্ধনা দেন রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগ আহবায়ক কাজী জমশেদ বাক্কি বিল্লাহ। তাকে স্বাগত জানিয়ে উপজেলার বিভিন্নস্থানে অর্ধ শতাধিক তোরণ নির্মাণ করেন পৌর আওয়ামী লীগের ওই নেতা।

পরে জেলা ও রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে কাজী বাক্কি বিল্লাহ’র মাধ্যমে ‘ম্যানেজ’ করে নেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্মীপুর সফরে গেলে, ওইদিন জেলা আওয়ামী লীগের সমাবেশ মঞ্চে স্থানীয় প্রবীণ নেতারা সুযোগ না পেলেও পাপুলকে মঞ্চে অতিথির আসনে দেখা যায়।

এনিয়ে ওই সময়ে ক্ষিপ্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিলো, কোটি টাকার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করেই পাপুল মঞ্চে অতিথি হন।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ রায়পুর আসনে মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে জোর লবিং করেন পাপুল। জেলা-উপজেলা ছাড়াও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে ম্যানেজ করে নেন।

বিশেষ করে চট্রগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। গুঞ্জন ছিল, চট্রগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতাকে কোটি টাকায় গাড়িও কিনে দিয়েছিলেন পাপুল।

জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ ছাড়াও, তার অনুসারী কর্মীদের কিনে দিয়েছিলেন অর্ধ শতাধিক মটরবাইক।

যদিও শুরু থেকেই রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একটি অংশ পাপুলের বিরোধীতা করেন।

লক্ষ্মীপুর-২ রায়পুর আসন ছেড়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগের মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টিকে। মনোনয়ন পান কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির নেতা মোহাম্মদ নোমান। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

এতে তার পক্ষে অবস্থান নেয় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বড় একটা অংশ।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের দুইদিন আগে রহস্যজনকভাবে নির্বাচন থেকে সরে, গা-ঢাকা দেন মহাজোট প্রার্থী মোহাম্মদ নেমান।

ওই সময় অভিযোগ উঠে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মহাজোট প্রার্থী নোমানকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেন পাপুল।

বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবুল খায়ের ভূঁইয়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও, বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনের কোথাও তাদের নির্বাচনী কর্মকান্ড ছিলো না। ভোটের দিন কেন্দ্রে দেখা মেলেনি এজেন্টদের।

ফলে পাপুলের পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবস্থানে খালি মাঠেই আপেল প্রতিক নিয়ে জয়ী হন পাপুল।

নামে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই তার নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
নির্বাচনের পর কুমিল্লার একটি আসন থেকে সংরক্ষিত কোটায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংসদ সদস্য বানিয়ে নেন তিনি।

শহিদ ইসলাম পাপুল ও সেলিনা ইসলাম স্বতন্ত্র থেকে সংসদ সদস্য হলেও সেটা ছিলো নামেমাত্র। তাদের দুজনকেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। তাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডও পরিচালনা করতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাক্কি বিল্লাহ ও আদনান চৌধুরী।

গত ফেব্রুয়ারীতে পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতে মানব ও মুদ্রা পাচারে অভিযোগ এনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৬ জুন রাতে পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হন।

তার কোম্পানীতে কর্মরত পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার দেখানো ও রিমান্ডে নেয়া হয়।পাপুল কুয়েতে যেতে ওই ৫ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩ হাজার দিনার ও প্রতিবছর ভিসা নবায়ন করতে তাকে বাড়তি টাকা দিয়েছেন বলে তারেদ অভিযোগ।

পাপুলের মতো অনেকেই রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসছে, এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন। পাপুলদের আর দোষ কী! যুগে যুগে পাপুলরা এমনই। তারা সুবিধাভোগীদের কিছু ‘সুবিধা’ দিয়ে ক্ষমতার সোনার হরিণ পেতে চাইবেই। এই ‘সোনার হরিণ’ যে দেশ লুটের হাতিয়ার!

কিন্তু কারা তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন দলে কারা দুর্বৃত্তায়নের চর্চা করছেন। ক্ষমতার সকল ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের সুযোগ দিয়ে দেশের অর্থনীতি লুন্ঠন করছেন।

আওয়ামী লীগের স্বার্থে ‘খন্দকার মোশতাকদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। ক্ষমতাসীন দলের এসব ‘সুবিধাবাদীদের’ এখনই রুখতে না পারলে, দলে পাপুলদের আগমন যতো বাড়বে; ততোই বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে।

-আবুল কালাম আজাদ,সম্পাদক-প্রবাস সময় ডটকম

সর্বশেষ খবর

সৌদিতে ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যু

0
  সৌদি আরবে কাজ করার সময় ভবনের ৩য় তলার ছাদ থেকে পড়ে মো. ইউছুপ (২৬) নামে এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বৃহম্পতিবার (৫ অক্টোবর) এ...

জনপ্রিয় খবর